সবুজ ডুয়ার্স, নীল পাহাড় আর এক টুকরো ইতিহাস - অর্ণব রায়
শীত আসলেই মনটা ছুটি ছুটি
করে। উত্তরবঙ্গে
থাকি তাই
হাত বাড়ালেই পাহাড় চা
বাগান আর
জঙ্গলের নীল
সবুজ ক্যানভাস। কিন্তু ওই
স্টেশনের কাছের
লোকের ট্রেন
মিস করা
বলে একটা
কথা আছে
না, সেটা আমার
ক্ষেত্রেও হাড়ে
হাড়ে সত্যি। কাজের চাপে
ঘরের কাছের
ভালোলাগার জায়গাগুলোতেও সব সময়
যাওয়া হয়ে
ওঠে না।
কালীপুজো, দীপাবলী আর ভাইফোঁটা মিটে যাবার পর বাঙালির প্রাণে একটা অদ্ভুত ফাঁকা ফাঁকা ভাবের সৃষ্টি হয়। সব উৎসব শেষ। ক্রিসমাস তো সেই প্রায় দেড় মাস পর। মনে সর্বক্ষণ একটা কি করি কি করি ভাব। এবছর পুজোয় কোভিড পরিস্থিতির কারণে ট্রেন বন্ধ থাকায় বন্ধুরা কেউ বাড়ি ফিরতে পারেনি। কালীপুজোর আগে ট্রেন চলায় তবুও এক বন্ধু বাড়ি ফিরতে পেরেছে। ওর সাথে প্ল্যান করছিলাম, ঠিক তথাকথিত কোনও ‘ট্যুরিস্ট ডেসটিনেশান’ নয়, কিন্তু মনকে ছুঁয়ে যাবে এমন কোনও জায়গায় একটা দিন কাটানোর। নীলাদ্রি আর আমি দুজনেই ডুয়ার্স সুন্দরীর প্রেমিক। আমি ইতিহাসের ছাত্র না হলেও, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস আমার আগ্রহের বিষয়। আর হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত উত্তরবঙ্গের ‘ডুয়ার্স’ নামক জনপদ ইতিহাসের নিরিখে নবীন হলেও যেহেতু আমাদের প্রাক্তন শাসক ব্রিটিশদের হাতেই তৈরি, তাই সেই সময়ের ইতিহাসের গন্ধ আজও ছড়িয়ে আছে এখানকার পথে-প্রান্তরে, অরণ্যে-পাহাড়ে।
গন্তব্য ঠিক হল রাঙ্গামাটি চা বাগানের ছোট্ট শ্রমিক
বসতি ‘চাইবাসা’ এবং চেল নদীর তীরবর্তী
রানীচেরা চা বাগান। জায়গা দুটো প্রথম দেখেছিলাম অরিন্দম শীল পরিচালিত ব্যোমকেশ
বক্সি সিরিজের ‘ব্যোমকেশ
পর্ব’(২০১৬)
ছবিতে। আর গৌতম ঘোষ পরিচালিত জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ‘আবার অরণ্যে’(২০০৩) ছবিতে। তখন অবশ্য জায়গাটার ভৌগোলিক
অবস্থান জানতাম না। কিন্তু
প্রথমবার সিনেমার পর্দায় দেখার সময়ই ভীষণ ভালো লেগে গেছিল। কি করে জায়গাদুটো খুঁজে পেলাম,
সেটা পরে বলছি।
আমার মোটরসাইকেলে চেপে ময়নাগুড়ি থেকে সকাল দশটায় শুরু হল আমাদের দুই বন্ধুর যাত্রা।
লাটাগুড়ি হয়ে গরুমারা জাতীয় উদ্যানের বুক চিরে সকাল পৌনে ১১ টায় পৌঁছালাম চালসার মোড়ে। সেখানে পুরী-তরকারী ও নতুন গুড়ের রসগোল্লা সহযোগে জলযোগ সেরে, মালবাজার শহর পেরিয়ে জাতীয় সড়ক ধরে কিলোমিটার দুয়েক এগোতেই, হাতের ডানদিকে সোজা উপরে উঠে গেছে ‘রাঙ্গামাটি টি এস্টেট’ এর রাস্তা। যেতে হবে সেই পথেই। সমতল ছেড়ে এবার কিঞ্চিৎ ঢেউ খেলানো উঁচু-নিচু পথে ছুটে চললো মোটরবাইক। পথের দুপাশে চা গাছের নয়নাভিরাম সবুজ ভেলভেট ছড়িয়ে আছে আদিগন্ত। বাঁ দিকে চাইলে দেখা যায়, দূরের খোলা উপত্যকার পিছনে ‘আকাশে হেলান দিয়ে’ ঘুমিয়ে আছে প্রুশিয়ান ব্লু রঙের হিমালয়ের শিবালিক রেঞ্জ। চা শ্রমিকরা পাতা তুলে রাখছে পিঠের নাইলনের জালের ব্যাগে। গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তায় সাইলি বাজার যাবার এই পথেই পড়বে রাঙ্গামাটি চা বাগানের বিশাল চা কারখানার শেড, সেখানকার যান্ত্রিক শব্দ আর মনমাতানো টাটকা চা পাতার গন্ধকে অগ্রাহ্য করে আমরা চললাম ডাইনে চাইবাসা-র পথে, সেই সবুজ চা বাগানের বুক চিরেই। কয়েকটা বাঁক নিয়ে কিছুদুর এগিয়ে দেখলাম কয়েকটা চা বাগানের কোয়ার্টার, সামনে ফুল আর সবজির বাগানের মাটি পায়ে আঁচড়ে কি যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে একটা মুরগি আর তার ছোট ছোট ছানারা। হাতের ডানদিকে একটা সাইন বোর্ডে ইংরাজিতে লেখা আছে CHAIBASA, বুঝলাম পৌঁছে গেছি। পথের পাশেই মাচার উপর একটা ছোট্ট মুদির দোকানে এক আদিবাসী বালক বসে। থামলাম। শব্দ বলতে এতক্ষণ কানে আসছিল বাইকের ইঞ্জিনের ফুড়ফুড়ুনি। সেটা থেমে যাওয়ায় কান যেন একটু আরাম পেল। একটা অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ।
এসেছি এখানকার এক প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র দেখতে। দোকানের
ছেলেটির কাছে ‘পুরানা কাবরিস্তান কা রাস্তা’ শুধোতেই ডান হাত তুলে
দেখিয়ে দিলো ‘উস তারাফ যাইয়ে’। ডাইনে একটা খেলার মাঠ,
প্রাইমারি স্কুল- সেপথে সামান্য এগিয়ে বাঁয়ে একটা বাঁক ঘুরেই পৌঁছে গেলাম আমাদের
গন্তব্যে। ‘চাইবাসা ব্রিটিশ সেমেট্রি’।
পাঁচ বিঘে জমির উপর এই সমাধিক্ষেত্রের সীমানা পাঁচিল বিভিন্ন জায়গায় ভেঙ্গে পড়েছে যত্নের অভাবে। প্রবেশপথটি অভিনব। কাঁধসমান উঁচু দেয়ালের উপর দিয়ে বসানো সিঁড়ি ডিঙিয়ে প্রবেশ করতে হয়। তারপরই রয়েছে সুদৃশ্য গথিক ও ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের মিশেলে তৈরি একটি খিলেন দেওয়া গেট। তার ছাদে মস জাতীয় উদ্ভিদ গজিয়ে ছেয়ে ফেলেছে পুরোটা। মেঝেতে মার্বেলের ফলকে কিছু একটা লেখা ছিল কিন্তু সেটা এখন আর পড়া যায় না।
ইউরোপিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত ব্রিটিশ আমলের এই সমাধিস্থল ছিল পশ্চিম ডুয়ার্সের সবচেয়ে বড় এবং পুরনো খ্রিষ্টান সমাধিস্থল। কাজেই ডুয়ার্সের ইতিহাসের আলোচনায় চাইবাসা সমাধিস্থলের যে বিশেষ ঐতাহাসিক গুরুত্ব রয়েছে সেকথা বলাই বাহুল্য। সচেতন পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে ‘ব্যোমকেশ পর্ব’ সিনেমার সেই দৃশ্যটি যেখানে ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ মল্লিক (কৌশিক সেন) ব্যোমকেশ বক্সী ( আবীর চট্টোপাধ্যায়) কে একটি পাঁচিল ঘেরা জায়গায় দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘খুব ওয়েল মেন্টেন্ড নয় কিন্তু, এই কবরখানার একটা ইতিহাস আছে।’ .......... বাস্তবেই এই কবরখানার একটা ইতিহাস আছে।
এই কবরখানাটি স্থাপিত হয়েছিল অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে
১৮৭৫ থেকে ৮৫ র মাঝামাঝি। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। সেসময় এই ডুয়ার্স
ছিল শ্বাপদ সংকুল অরণ্যে ঘেরা। আবহাওয়া ছিল অতিরিক্ত জলীয় বাস্পের কারনে অস্বাস্থ্যকর। ম্যালেরিয়া আর ব্ল্যাকওয়াটার
ফিভারের আঁতুড়ঘর। সেই পরিবেশে সদ্য ব্রিটেন থেকে আগত টি প্ল্যানটার কিংবা তাঁদের
পরিবারের সদস্যদের কারও মৃত্যু ঘটলে এখানে তাঁদের সমাধিস্ত করা হত। কফিনের উপর পড়ত
মাটি আর সাথে গির্জার পাদ্রির প্রার্থনা ‘.......we therefore commit this body to the ground, earth to earth, ashes to ashes, dust to dust; in sure and certain hope of the Resurrection to eternal life.’ সেই প্রার্থনার প্রতিধ্বনি যেন আজও বুকে নিয়ে বেঁচে আছে চাইবাসা সমাধিস্থল।
একসময় এখানে প্রায় ১০০ টি সমাধি থাকলেও বর্তমানে কুড়ি পঁচিশটির বেশী চোখে পড়ে না। যেগুলি এখনও অটুট আছে তাদের অবস্থাও খুবই করুণ। কোনও কোনও সমাধির ফলক বা হেডস্টোনের ইটালিয়ান মার্বেলের উপর যে পিতলের হরফে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্ম মৃত্যুর তারিখ ইত্যাদি লেখা থাকতো সেগুলি আজ উধাও। তবুও যে সমাধিগুলি রয়ে গেছে তার মধ্যে সবথেকে ভালো অবস্থায় রয়েছে রাঙামাটি চা বাগানের ব্রিটিশ ম্যানেজার W. D. Coull এর স্ত্রী Marian Ida র। যাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৯১৯ সালের ২১শে মার্চ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ম্যানেজার সাহেব তাঁর স্ত্রীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই কবরটির উপর একটি অসাধারণ সুন্দর পরীর শ্বেতশুভ্র মর্মরমূর্তি স্থাপন করেছিলেন। কালের করাল গ্রাসে তার হাত দুটি হারিয়ে গেলেও, অক্ষত আছে ডানাদুটি। বড় করুণ দৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে সমাধির দিকে।
এছাড়াও সাতখাইয়া চা বাগানের Fredric Charls Jordon ( মৃত্যু-১৯২৩ সালের ১৮ ই নভেম্বর মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে), বাগ্রাকোট চা বাগানের মালিক William Valentine Sheacer (মৃত্যু- ১৯১৮ সালের ১০ই আগস্ট মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে) , মিনগ্লাস চা বাগানের মালিক Jhon Wright এর পঞ্চম পুত্র George Murooch Wright (মৃত্যু- ১৯০৫ সালের ৩রা অক্টোবর মাত্র ২৮ বছর বয়সে), Roderick Mc.leod (মৃত্যু- ১৮০৯ সালের ২৩শে আগস্ট মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে), ডামডিম চা বাগানের John William Thomson (মৃত্যু- ১৮৮৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারী), লিশ রিভার চা বাগানের James Jnson Anderson ( মৃত্যু- মাত্র ২৭ বছর বয়সে), John Jaems Letham Logan (মৃত্যু- ১৯৪৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর) এবং বড়দীঘি চা বাগানের Swinton Thomas Agacey (মৃত্যু-১৯৬৮ সালের ৬ই মার্চ) প্রমুখের সমাধি উল্লেখযোগ্য।
এদের
কেউ স্বদেশ স্বজনকে ছেড়ে জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে, কেউ বা নতুন দেশ দেখার আগ্রহে,
কেউ স্বামীর সাথে থাকতে সুদূর ব্রিটেন থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেছিলেন। কিন্তু
নিয়তির পরিহাসে এঁদের কেউ ফিরে যেতে পারেননি স্বভূমে। সবুজে ঘেরা চা বাগানের এই
শান্ত সমাহিত সমাধিভুমিতে শুধু পাখির কলতান আর পাহাড়িয়া বাতাসের শীতলতায় তাঁরা চিরঘুমের
দেশে পাড়ি দিয়েছেন।
দুই বন্ধু কিছুক্ষণ বসি ঘাসের উপর, উদাস মনে
কেমন একটা বোঝাতে না পারা কষ্টে মন ভারাক্রান্ত হয়। একটু আগেও রোদ ছিল, এখন এক খণ্ড
পাতলা কালো মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে সূর্য। পশ্চিম দিকের দেয়ালের উপর এসে বসেছে
একটা ইসাবেলিন শ্রাইক পাখি। হেমন্তের হাল্কা বাতাসে পাতা ঝরাচ্ছে ইউক্যালিপ্টাস।
বৃষ্টি আসবে নাকি? উঠে পড়ি।
খুব দ্রুত
উপযুক্ত ভাবে রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থা না নিলে ভগ্নপ্রায় এই ইতিহাস কালের গর্ভে
হারিয়ে যাবে এক সময়। কিন্তু টি ট্যুরিজমের সাথে সাথে ইতিহাস ভিত্তিক পর্যটনের
মাধ্যমে দেশ বিদেশের পর্যটকদের মধ্যে পরিচিতি লাভ করলে, ডুয়ার্সের পর্যটন
মানচিত্রে স্থায়ী জায়গা করে নেওয়ার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে চাইবাসার। দরকার শুধু চা বাগান কর্তৃপক্ষ
আর পর্যটন দপ্তরের একটু সমন্বয় আর ভালো কাজ করার সদিচ্ছা। এই এলাকার খুব কাছেই
থাকেন মালবাজার বিধানসভার বিধায়ক, যাঁর বাল্যকাল রাঙ্গামাটি চা বাগানেই কেটেছে, এই
লেখা যদি তিনি পড়েন তাহলে তাঁর কাছে আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করব এই ঐতিহাসিক
স্থানটির সংস্কারের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, নবগঠিত ঝাড়খণ্ড
রাজ্যেও চাইবাসা নামে একটি শহর রয়েছে। সেটা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য জায়গা। এই লেখা
পড়ে গুগল সার্চ করলে আপনারা শুধু ঐ চাইবাসা সম্পর্কেই তথ্য পাবেন। কারণ ডুয়ার্সের
চাইবাসা সম্পর্কে গুগলে কোনও তথ্য নেই বললেই চলে। আসলে ব্রিটিশ টি প্ল্যানটাররা
ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ছোটনাগপুর, সিংভুম মানভূমের মালভূমি অঞ্চল থেকে বিভিন্ন আদিবাসী জনজাতির
মানুষকে উত্তরবঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করার জন্য।
মানুষের একটা প্রবনতা হল, নতুন জায়গায়
গিয়ে পুরনো জায়গার নামে নতুন জায়গার নামকরন করা (সেই কারনেই আমেরিকার বিভিন্ন
এলাকায় অজস্র ব্রিটিশ নামের শহর দেখা যায়।) ডুয়ার্সের চাইবাসার নামকরণের পিছনেও
সেই ধরনের কোনও কারণ থাকতে পারে।
যাইহোক, মোটরবাইক স্টার্ট করে এগিয়ে যাই আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্যের পথে এখান থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে রানীচেরা চা বাগানের পথে। সাইলি বাজার পেরিয়ে চা বাগানের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই। দুপাশে চা বাগান থাকলেও রাস্তা থেকে চোখে পড়েনা। কারণ পথের দুপাশেই এক মানুষ উঁচু হলুদ গোলাপি ল্যান্টারনা ফুলের ঝোপ প্রায় নুয়ে পড়েছে রাস্তার উপর। বেশ কিছুটা এগিয়ে হঠাৎ করেই চা বাগান আর ঝোপঝাড় শেষ হয়ে যায়। ডানদিকে তাকাতেই চোখে পড়ে এক অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ, দূরে সেই নীল পাহাড়শ্রেণী আর তার সামনে চেল নদীর উপত্যকা। রাস্তা থেকে নদীর মাঝে প্রায় তিনশ মিটার প্রস্থের এক বিরাট সমতল মাঠ, একদিকে সামান্য কিছু গাছ। মনে মনে লাফিয়ে উঠি! আরে, এটাই কি সেই মাঠ যেখানে ‘আবার অরণ্যে’ ছবিতে অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) অপর্ণা (শর্মিলা ঠাকুর) কে বলছেন ‘তোমার মনে আছে Cessna flight, এইখানে ল্যান্ড করেছিলাম?’ উত্তরে অপর্ণা বলছেন ‘মনে নেই আবার, আমার তো প্রায় হার্টফেল হয়ে যাচ্ছিল।’ এরপর বাগানের ম্যানেজারের স্ত্রী( চৈতি ঘোষাল) এগিয়ে এসে বলেন ‘অসীমদা, কি সুন্দর না, হঠাৎ করে একটা খোলা প্রান্তর!’ উত্তরে অসীম বলেন ‘ এটা আসলে একটা এয়ারফিল্ড, আগে একসময় এখানে প্লেন নামতো।’ তারপর সেই ‘আজি মর্মর ধ্বনি কেন জাগিল রে’ কোরাস গেয়ে সমবেত নাচ।
এখানে কিন্তু আগে সত্যিই একটা এয়ার ফিল্ড ছিল, ইন্ডিয়ান টি আ্যাসোসিয়েশানের ডুয়ার্স ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান গ্রিয়ারসন সাহেব তাঁর নিজস্ব ছোট বিমান নিয়ে এখানে এসে নামতেন গলফ্ খেলতে। বর্তমানে ১৪৮.২ একর জুড়ে বিস্তৃত এই গলফ্ কোর্টটিই সম্ভবত উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় গলফ্ কোর্ট। প্রতি বছর ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে এখানে গলফ্ টুর্নামেন্টের আসর বসে। দেশের নানান জায়গা থেকে গলফাররা আসেন সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। দুচোখ ভরে সেই বিরাট প্রান্তরের শোভা উপভোগ করতে করতে একটু এগিয়ে বাঁ দিকে চোখে পড়তেই থামলাম। একটা বাড়ি।
সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘WESTERN DOOARS CLUB’।গলফ মাঠটি এই ক্লাবেরই সম্পত্তি। পাশেই গেট। সেখান দিয়ে প্রবেশ করলে লাল সাদা রঙের বিরাট বাংলো। সামনেই গাড়ি দাঁড়ানোর পোর্টিকো। আর দুপাশে কাঁচের সার্সি বসানো কাঠের ফ্রেমের অনেকগুলি জানালা। তাদের ফ্রেমের রঙও সাদা। আর অনেক উঁচুতে ওয়াটারপ্রুফিং করা মোটা করোগেটেড টিনের ছাউনি। গড়ন দেখে মনে হল বাকিংহামের বিলিতি টিন।
সামনে কেয়ারি করা পাতাবাহারে ঘেরা বিরাট নয়নাভিরাম নরম সবুজ ঘাসের লন। পেছন দিকেও একটা ঢালা বারান্দা রয়েছে দেখলাম। পাশেই একটা বিশাল বোগেনভেলিয়ার ঝাড়ে থোকা থোকা বেগনি রঙের ফুল ফুটে আছে। স্যুইমিং পুলও একটা রয়েছে, কিন্তু তাতে জল টল নেই। ক্লাবের বর্তমান সদস্যসংখ্যা একশো তিন জন। সকলেই মূলত চা শিল্পের সাথে জড়িত। আমাদের দুজনকে গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতে দেখে চৌকিদার এগিয়ে আসে। কথায় কথায় জানতে পারি ক্লাবের কর্তারা নাকি হুকুম জারি করেছেন যে এই কোভিড পরিস্থিতিতে বাইরের কাউকে যেন ক্লাবের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া না হয়। অগত্যা কি আর করা, লনে কিছুক্ষণ বসে ছবি টবি তুললাম।শুনেছি রানীচেরা চা বাগানের এই ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স ক্লাব (আগে নাম ছিল ইউরোপিয়ান ক্লাব) এর ভেতরে একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো আছে। আছে তিন হাজারেরও বেশী বই সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি ও রিডিং রুম। বলরুম ডান্সের জন্য আছে বিশাল কাঠের ডান্স ফ্লোর।
লন থেকে বেরিয়ে উলটোদিকের বিরাট গলফ মাঠ পেরিয়ে নদীর
ধারে গিয়ে বসি। চেল নদীর পাথুরে বুকে কয়েকটি ছেলে ফুটবল নিয়ে মেতে আছে। একটা
গাছতলায় কয়েকজন দেখলাম কোদাল গাঁইতি নিয়ে বসে বিশ্রাম করছে। ‘ওরা কাজ করে’। নদীর চর থেকে বালু পাথর লরিতে
তোলার কাজ। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। দূরের পাহাড়ের ঢালে গোধূলির
সূর্যাস্তের দৃশ্য মনোরম দেখাবে নিশ্চয়ই, কিন্তু দীর্ঘ গাছের ছায়ারা মনে করিয়ে দেয়
সূর্য ডুবতে বেশী দেরি নেই, এই বেলা ‘মন চলো নিজ নিকেতন।’ আবার মোটরবাইক স্টার্ট করি। সেই
একই চা বাগান ঘেরা পাকা রাস্তায় সোনাঝরা রোদ মাখতে মাখতে রওনা দিই ডামডিমের পথে।
সেখানে রাস্তার ধারের একটা ধাবায় চিকেন মোমো আর চাউমিন দিয়ে লাঞ্চ সেরে এগিয়ে চলি মাল
মহকুমার সদর শহর মালবাজার পেরিয়ে চালসার দিকে।
চালসা থেকে বাঁদিকে পাহাড়ি পথে সামান্য উঠে ‘ভিউয়ার্স পয়েন্টে’ বসে সূর্যাস্ত দেখলাম।
আগেও বহুবার এসেছি এখানে। ভীষণ ভালো লাগে জায়গাটা। নীচের রেললাইন দিয়ে একটা মালগাড়ি ঘস ঘস শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে নাগরাকাটার দিকে। পাতলা সরের মত একটা কুয়াশা নামছে নীচের উপত্যকায়। দক্ষিণ দিকে তাকালে দূরে অস্পষ্ট দেখা যায় টিয়াবনের গাছের মাথাগুলি। পশ্চিম আকাশে ক্রিমসন রঙের সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে একটা দিন শেষ হয়ে গিয়ে সন্ধ্যের আঁচলে মুখ ঢাকছে ডুয়ার্স সুন্দরী। নীচে নেমে এলাম। তারপর গোলাই পেরিয়ে বাইক ছুটল ঘরের টানে, ময়নাগুড়ির পথে। ১৯ শে মভেম্বর ২০২০
* তথ্যঋণ- রাঙামাটি বাগানের চাইবাসা সমাধিস্থল ও রানীচেরা বাগানের 'ইউরোপিয়ান ক্লাব' সিনেমার পর্দায় প্রথমবার দেখলেও, মালবাজার পরিমল মিত্র মহাবিদ্যালযের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার ভৌমিকের লেখা পশ্চিম ডুয়ার্সের ইতিকথায় মালবাজার' নামক গবেষণামূলক ও তথ্য সমৃদ্ধ বইটি থেকেই জানতে পারি জায়গাদুটির অবস্থান ও ইতিহাস সম্পর্কে। অধ্যাপক ভৌমিককে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই, আমাকে বিভিন্ন সময়ে নানা তথ্য ও ঠিকানা দিয়ে সাহায্য করার জন্য। ডুয়ার্স অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকেরা বইটি পড়ে দেখতে পারেন। অনেক অসাধারণ ও নতুন তথ্য এবং ছবি রয়েছে বইটির দুই মলাটের মাঝে।
**বন্ধু নিলাদ্রী পালকেও ধন্যবাদ এই ভ্রমণে আমার সঙ্গী হবার জন্য। ময়নাগুড়ির ছেলে হলেও নীলাদ্রি বর্তমানে নবদ্বীপ আদালতে করণিক পদে নিযুক্ত। আমরা দুজনেই এখন 'সংসারী পুরুষ' তাই ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই সেই স্কুল কলেজের দিনগুলির মত বাউন্ডুলেপনা করার। তাই বহুদিন পর আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসে(১৯ শে নভেম্বর) এমন ভাবে বেড়ানোর 'ছাড়পত্র' দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই আমাদের স্ত্রীদেরকেও।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteRe
ReplyDeleteThis Wii help to know the ancient
ReplyDeletehistory of Tea plantaton during
British period.
Kindly attend Dam Dim Tea Estate of
TATA TEA (now APPL). ..
Prem Tirkey is now head factor babu who was my student. Referrnce .
Wish you success to stretch
Out the British administration
In Tea plantation.
.. .. .. .. mama... ..
Nice
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete