ফিরে দেখা: আমার ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি- অর্ণব রায়

           

 আমাদের ছোটবেলায়, যখন আমি প্রাইমারী স্কুলে পড়ি, সেই সময়টায় পুজো মানেই ছিল বছরের আর পাঁচটা সময়ের চেয়ে একটু অন্য ভাবে থাকা। স্কুলে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষা হয়েই পড়ে যাবে পুজোর ছুটি। সেই সময় পড়ার বইতে মন বসানো যে কী দুঃসাধ্য ব্যাপার তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত হাওয়ায় ঢেউয়ের মত দুলছে।মাঝে মধ্যে দু একটা কাশফুলের ঝোপের সাদা রং যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে হয়ে যাচ্ছে আকাশের ঝক্ঝকে নীলে ভেসে বেড়ানো ফোলা ফোলা সাদা মেঘের সাথে।এদিকে বাবার কড়া হুকুম “ ‘প্রনবেশ জানা’ র অঙ্কবইয়ের সাত অনুশীলনীর প্রথম পনেরোটা অঙ্ক করে রাখবে।আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখব।” কী আর করা, অগত্যা উৎপাদক বিশ্লেষণে মন দিতে হত ঝাপসা চোখে।বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল পড়াতেন ছোটমাসি। আমাদের স্কুলটা ছিল সকাল বেলার স্কুল। সকাল ছটা থেকে দশটা। তারপর বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু ঘুম। বিকেল হতে না হতেই ছোটমাসি পড়াতে চলে আসতেন। সারা বছর রুটিনটা এরকম থাকলেও পুজোর আগে সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেত। কেমন যেন একটা মন উড়ু উড়ু ভাব। পাড়ার ক্লাবের পুজোর প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধা শুরু হয়ে গেছে।টুকটাক পুজোর বাজার শুরু করে দিয়েছেন বড়রা।ছোটবেলায় আমার জামা কাপড়ের চেয়েও বেশী পছন্দের জিনিস ছিল জুতো।পুজোর আগে খবরের কাগজের পাতা জোড়া জুতোর বিজ্ঞাপনের দিকে দীর্ঘক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। পুজোর প্রায় একমাস আগেই ওটা কেনা হয়ে যেত। আর সব কিছু কেনা হয়ে যাবার পর পাড়ার সবাই কে কী কিনল, কার কটা জামা হল এবার, তা নিয়ে আমাদের ছোটদের মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে যেত।

                  আর বিশ্বকর্মা পুজোর ঢাকে কাঠি পড়া মানেই শুরু হয়ে গেল কাউন্ট-ডাউন। আর মাত্র কটা দিন বাকি! বিশ্বকর্মা পুজোটা যেন একটা ফাইভ কোর্স ডিনারের স্টারটার ডিশ। সবচেয়ে বড় বিশ্বকর্মা পুজোটা হত ‘নর্থ বেঙ্গল মোটর কর্মী সংঘ’তে।পুজোর দিন দুপুরে মণ্ডপের সামনের রাস্তা টাকেও ভালো মত জল আর ঝাঁটা সহযোগে ঝকঝকে করে ফেলা হত।(যদিও সে সময় আমরা ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ এর নাম শুনিনি, কিন্তু চারপাশ টা পরিষ্কার রাখা একটা অত্যন্ত সাধারন অভ্যাস ছিল।) রাস্তার দুপাশে শয়ে শয়ে লোক শালপাতার থালা নিয়ে খেতে বসে যেত।বিশাল বিশাল ডেকচি হাঁড়ি আর কড়াইতে রান্না হচ্ছে, খিচুড়ি আর লাবড়া। তারপর বালতি তে করে নিয়ে, ডাবু হাতা দিয়ে রাস্তার দুপাশে বসে থাকা সবার পাতে পাতে পরিবেশন করা হচ্ছে গরম গরম। সে একটা দেখার মত দৃশ্য। ওই পূজা কমিটি থেকে খিচুড়ির হাঁড়ি আসত আমাদের বাড়িতে। খিচুড়ি খাবার নেমন্তন্ন থাকত বাবার আত্মীয় ব্রজেন দাদুর বাড়িতেও। ওঁদের একটা বড় লেদ কারখানা ছিল, সেটা এখনও চালু আছে।আর নেমন্তন্নের কার্ড আসত স্থানীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকেও।ভীষণ সুস্বাদু হত ওখানকার খিচুড়িটা। সেই স্বাদ যেন আজও মুখে লেগে আছে। কালি ঝুলি মাখা গ্যারেজ, লেদ কারখানা গুলিও আলো ঝলমলে হয়ে সেজে উঠত ওই একটা দিনের জন্য।

                 বিশ্বকর্মা পুজোর পর নেক্সট সেগমেন্ট ছিল মহালয়া। আর মহালয়া মানেই আগের দিন রাতে মাংস ভাত দিয়ে পিকনিক। রান্না হত কারও বাড়ির উঠনে ত্রিপল খাটিয়ে, কাঠের আগুনে।সংক্ষিপ্ত মেনু- ভাত, ডাল, একটা কিছু ভাজা, গরম গরম মাংসের ঝোল।আর তাতে বড় বড় করে কাটা আলু।শেষ পাতে চাটনি।কখনও ঘরোয়া সাউন্ড বক্সে গান বাজিয়ে, কখনও নিজেরাই গান গেয়ে, আগুনের ধারে বসে সবাই মিলে গল্প করতে করতে খাওয়া দাওয়া। তখন ফেসবুক, হোয়াটস্আ্যপ ছিলনা, কিন্তু পাশের বাড়ির মানুষটার সুখ দুঃখের খোঁজ আমরা রাখতাম। মহালয়ার আগের দিন পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন হত অদ্ভুত আর মজার সব লটারী প্রতিযোগিতার। পুরষ্কার পাঁচ কেজি খাসীর মাংস, অথবা ২ কেজি মুর্গীর মাংস ইত্যাদি। যে জিতে যেত তাকে সবাই ধরত, ‘অ্যাই, লটারী জিতেছিস খওয়াতে হবে।’ অতয়েব সেই সদ্য  পুরষ্কার প্রাপ্ত মাংস দিয়ে ভোজ হত সেদিন রাতেই।

              মহালয়ার সকালটা যেন ছিল একটা অলৌকিক ভোর, পুব দিকের আকাশ সবে ফর্সা হচ্ছে। ঘুম ভাঙত রেডিওতে বিরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলায় সেই আদি-অকৃত্তিম চণ্ডীপাঠ শুনে। এফ এম তখনও আসেনি, সম্প্রচার হত মিডিয়াম ওয়েভেই।আকাশবাণী কোলকাতার অনুষ্ঠান রিলে করে সম্প্রচার করা হত শিলিগুড়ি কেন্দ্র থেকে। এই একটা জিনিস একই রয়ে গেল এখনও। মহালয়ার সকালের এই ব্যাপার টা আজও প্রায় একই রকম আছে। তখন  বাড়িতে সবে একটা সাদা-কালো ১৪ ইঞ্চি টি.ভি সেট এসেছে। এতদিন শুনেই এসেছি, এবার নাকি টি. ভি. তেও দেখতে পাব ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।দেখলামও। কিন্তু ওই যে রেডিওতে শোনার রোমাঞ্চ, সেটা একটা আলাদা ব্যাপার।  বাইরে একটা পাতলা কুয়াশার আবরনের মধ্যে দিয়ে সূর্য উঠছে, বাগানের শিউলি ফুল গছের দিক থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। নরম সূর্যের আলোয় ধোয়া ধানক্ষেতে আর আলপথের ঘাসের উপরে উপর চিকচিক করছে শিশিরের ফোঁটা, যেন পল কাটা হীরের কুচি। বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরের এই দৃশ্য দেখছি আর রেডিও থেকে ভেসে আসছে ‘বাজলো তোমার আলোর বেনু, মাতল রে ভুবন।’

           আর মাত্র সাত দিন! তারপরই শুরু হয়ে যাবে, বাঙালীর সেরা উৎসব........দুর্গাপুজো।মা আসবেন আমাদের কাছে। আমাদের ছোট্ট শহর ময়নাগুড়িতে তখন পুজোর জাঁক জমক এখনকার মত না হলেও, ওই কটা দিন আমাদের কাছে ছিল একটা অন্য জগৎ। বাইরে ইচ্ছে মতন খওয়া দাওয়া , প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে নতুন জামা জুতো পরে ঘুরে বেড়ানো, বারুদ ভরা ক্যাপ ফাটানো বন্দুক নিয়ে চোর পুলিশ খেলা। ওই কটা দিন নো বকা, নো শাসন, যা ইচ্ছে তাই করার স্বাধীনতা।আমাদের প্রতিবেশি এক দিদা যিনি আমার ভীষণ আপন আর কাছের মানুষ ছিলেন, বয়েসের ভারে ন্যুব্জ হলেও আমায় হাত ধরে পাড়ার ‘ইয়ুথ ক্লাব’এর পুজোমণ্ডপে নিয়ে যেতেন। ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে প্রনাম করতে করতে আমায় বলতেন ‘এই ভাবে নম কর।’করতাম। বুঝতাম না মানুষ কেন ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রনাম করে? কিন্তু করতে ভালো লাগত। আর আমার মায়ের মা, মানে আমার দিদুনের হাত ধরে যেতাম সাহা পাড়ার ‘বাঘাযতীন ক্লাব’ এর মণ্ডপে। মণ্ডপ থেকে ফিরলে আমার হাতে দশটা টাকা দিয়ে বলতেন, ‘কিছু কিনে খাস’। বেশ লাগত সেসব দিন।দিদুন এখন আর আমাদের মধ্যে নেই, দিদুনকে বড্ড মিস করি পুজোর সময়টাতে।

          পুজোর সময় দিন গুলো একরকম, আবার রাত গুলো একদম অন্য রকম।এখনকার মত ডিজিটাল এল. ই. ডি. বাতির চোখ ধাঁধানো আলো নয়, চন্দননগর থেকে আসত ছোট ছোট টুনিবাল্ব আর বাঁশের বাখারি দিয়ে বানানো ‘লাইটিং’ । টুনির গায়ে লাল নীল হলুদ সবুজ প্লাস্টিক জড়িয়ে আলাদা আলাদা রঙের আলোর বাহার ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। সেই মৃদু আলোয় তৈরি হত একটা মায়াবী পরিবেশ। কাঠের রোলারের উপর তামার পাত জড়িয়ে সেটাকে ফ্যানের মোটর দিয়ে ঘুরিয়ে আলোর জ্বলা-নেভা মডিউলেট করা হত।আর তার ফলে একটা একটানা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ আর আলোর ফুলকি বেরিয়ে আসত রোলার থেকে।এখনও ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, যে কম্পিউটার ব্যবহার না করেই কি ভাবে শুধুমাত্র মাথা খাটিয়ে আর হাতের কৌশলে অমন অসাধারন আলো তৈরি করতেন সেযুগের আলোক শিল্পীরা। যে সব  পুজো কমিটির বাজেট কম তারা টিউব লাইটের গায়ে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ প্রভৃতি রঙের সেলোফেন জড়িয়ে, রঙিন নরম আলোয় সাজিয়ে দিতেন মণ্ডপ আর রাস্তা। সেই আলোর তলা দিয়ে যাবার সময় আবার অনেকেরই চোখে পোকা ঢুকে যেত। সে এক কেলেঙ্কারী ব্যাপার।

                  আমার মা বাবা দুজনেই বামপন্থী মানুষ। বিশেষ করে বাবা। কোনও পুজোতেই বাবার সঙ্গে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বেড়ানোর কোনও স্মৃতি আমার নেই। আমার মা অনেক সময় নিয়ে যেতেন, তবে খুব বেশী সময় দিতে পারতেন না। পুজোর সময় বাবা ব্যাস্ত থাকতেন তাঁর রাজনৈতিক দলের বুকস্টল নিয়ে। বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড় থেকেই বাঁশ কেটে নিয়ে স্টল বানাতেন পার্টির ‘কমরেড’ কাকু রা। পার্টির অনেক লোক জন বাড়িতে আসত ঐ স্টলে যোগদান করতে। মা তাঁদের জন্য হাসিমুখে খিচুড়ি রান্না করতেন হাঁড়ি ভরে। যারা সে সময় আসতেন তাঁরা আমার আত্মীয় না হলেও আমার বেশ লাগত ওদের সাথে গল্প করতে। তারাও সবাই আমার নানান আব্দার মেনে নিতেন। অনেক সময় সন্ধ্যের পর এক দু ঘণ্টা সেখানেও আমায় নিয়ে বসিয়ে রাখতেন মা। সেই লাল শালু দিয়ে মোড়া ছোট্ট স্টলে সাজানো থাকতো নানান রকম বইপত্র। অনেক পরিচিত অপরিচিত  মানুষ আসতেন, বই টই নেড়ে চেড়ে দেখতেন। বাবা মা তাঁদের সাথে গল্প করতেন, আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম রাস্তার ভিড়ের দিকে। যদি কোনও বন্ধু, প্রতিবেশী চোখে পড়ে তো তাদের দলে ভিড়ে যাব।পুজোর সন্ধ্যেটা এভাবে নষ্ট করার কোনও মানে হয়? বাবার পার্টির অন্যান্য ‘কমরেড’ কাকুদের দেখতাম,তাঁরা একেক জন একটা করে কৌটো হাতে নিয়ে ঝাঁকাচ্ছেন ভিড়ের মধ্যে। ল্যাকটোজেন এর কৌটো, মাথায় পয়সা ঢোকাবার জন্য একটা চওড়া ফুটো। কৌটোর গায়ে সাদা কাগজ আ্যরারুটের আঠা দিয়ে সাঁটা।আর তাতে লাল কালিতে লেখা আছে, ‘সংগ্রামী তহবিলে মুক্ত হস্তে দান করুন।’একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিলো।একজন প্রৌঢ়া হেঁটে আসছেন ভিড়ের মধ্যে।তাঁর সামনে গিয়ে জনৈক কমরেড কাকু কৌটো ঝাঁকাতেই তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে একটা দু টাকার কয়েন বের করলেন, তার পর পায়ের চটি জুতো খুলে রেখে, কাকুর হাতের কৌটোটাকে হাত ছুঁইয়ে প্রনাম করে, কয়েন টা ফুটো দিয়ে কৌটোর মধ্যে ফেলে দিলেন। তারপর চটিটা আবার পায়ে গলিয়ে নিয়ে ভিড়ে মিশে গেলেন। ঘটনাটা দেখে কাকুও হাঁ, আমিও হাঁ। তখন বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝি এই হল আমার দেশ, আমার ভারতবর্ষ, মহামানবের মিলনক্ষেত্র, যেখানে একজন ধর্মপরায়ণ হিন্দু আর একজন নিরীশ্বরবাদী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারেন। ভদ্রমহিলা হয়তো লাল শালু আর লোকজন দেখে টেখে স্টল টাকেও পুজো সংক্রান্ত কোনও কিছু মনে করে থাকবেন। কিন্তু সেই শারদ সন্ধ্যোয় ঐ প্রৌঢ়ার আচরণের মধ্যে যে ভক্তি আর বিশ্বাসের ঔজ্জ্বল্য দেখে ছিলাম তা আমার চিরকাল মনে থাকবে।

                  এখনকার মত থিমের বাড়াবাড়ি আর বাজেটের রেশারেষি নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকেও খুব একটা ছিলনা। প্যান্ড্যেল আর প্রতিমা গুলিও বেশীর ভাগই তৈরি করতেন স্থানীয় ডেকরেটার আর প্রতিমা শিল্পীরাই।কিন্তু তাতে আমাদের পুজোর আনন্দে কোনও দিন এতটুকুও ভাঁটা পড়েনি। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী প্রতিটা রাতেই পায়ে হেঁটে চক্কর দিতাম আমাদের ছোট্ট শহরটা, কখনও বন্ধুদের সাথে, কখনও বা প্রতিবেশী আবার কখনও আত্মীয় পরিজন দের সাথে। পাড়ার সবার মধ্যেও একটা সৌভ্রাতৃত্ত্বের বন্ধন ছিল। যেটা আজ অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে গেছে।প্রতি রাতেই বাইরে কিছু না কিছু খেয়ে আসা- রোল, চাউমিন, মোমো, মোগলাই পরোটা, ফুচকা, আলুর চপ, ফুলুরি, জিলিপি, বোঁদে। তখনকার দিনে এযুগের মত সস্তার বিরিয়ানির দোকান অথবা দামী রেস্তরাঁ কোনওটাই এখানে সেখানে গজিয়ে ওঠেনি। বাইরের খাবার বলতে আমরা এগুলোই বুঝতাম। মেলাতে বিক্রি হত গোলাপি আর সাদা ‘বুড়ির চুল’ বা ‘হাওয়াই মিঠাই’। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। আর ছিল কেরোসিনের কুপীর আলোয় পসরা সাজিয়ে বসা ‘মিশাল’ ওয়ালা কাকুরা। পছন্দ মত বানিয়ে দিতেন মুচমুচে মুখরোচক ছোলা, মটর, বাদাম, শসা, লঙ্কা, চানাচুর মিশ্রিত ‘মিশাল’। ঠোঙা থেকে বেরিয়ে আসত অপূর্ব জিভে জল আনা সুঘ্রান। ঐ গন্ধটা ছাড়া ছোট বেলার পুজোর দিন গুলির কথা.......ভাবাই যায় না।মিশালওয়ালারা এখনও আছেন। কিন্তু সেই মন কেমন করা গন্ধটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল হঠাৎ করেই।

           বড় মাসি আর মেসো কোনও কোনও বছর পুজোয় বেড়াতে আসতেন মামাবাড়ি তে। আমাদের বাড়ি থেকে মামাদের বাড়িটা খুব কাছে। হেঁটে গেলে দশ মিনিট। ধানের ক্ষেতের আলপথ বেয়ে রাস্তা। যখন তখন চলে যেতাম মামা-মাসিদের কোলে চেপে। সেইসব বছর গুলোয় খুব আনন্দ হতো। মামাবাড়ি তে দারুন খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হতো। এখনও বড় মাসি আর মেসো দুজনেই প্রচুর বাজার করতে আর সবাইকে খাওয়াতে ভীষণ ভালোবাসেন। বড়মামা আর দাদু পুকুরে জাল ফেলে, আবার কখনও বা ছিপ দিয়ে মাছ ধরতেন। সেই সব টাটকা মাছের স্বাদই আলাদা।পুজোর ছুটিতে আমি নিজেও যে কত দুপুর বেলা স্রেফ পুকুরে ছিপ ফেলে কাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সন্ধ্যের পর মেসো সবাইকে নিয়ে যেতেন পুজো দেখাতে। পায়ে চালানো তিন চাকার রিক্সা ভ্যানে চেপে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা, খাওয়া-দাওয়া, ছবি তোলা।   তখন ফোটো স্টুডিওতে গিয়ে সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তোলার রেওয়াজ ছিল। ফিল্ম ক্যামেরায় ছবি তোলা হতো তখন।তাই সাথে সাথে দেখতে পেতাম না, যে কেমন ছবি উঠল। দুদিন পরে গিয়ে ছবির প্রিন্ট নিয়ে আসতে হতো। ছোটমাসি আর মেজো মাসির তখনও বিয়ে হয়নি। ওঁরা দুজনেই আমায় ভীষণ স্নেহ করতেন।এখনও করেন।তবে তখন আমার দেহে তো এখনকার মত ‘স্নেহ’ পদার্থ জমেনি, যথেষ্ট রোগা ছিলাম, তাই মামা- মাসিরা যখন তখন কোলে, ঘাড়ে তুলে নিতেন।

        আর একটা বিষয় নিয়ে কথা না বললে স্মৃতিচারণা সম্পূর্ণ হবে না, সেটা হল পুজোর গান। প্রতি বছর পুজোর আগেই বেশ কিছু বাংলা গান বা পল্লী গীতির ক্যাসেট বাজারে আসত। সেগুলো ক্যাসেটের দোকানে গম্ গম্ করে বাজত। মানুষ যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে শুনতেন সেসব গান।সঙ্গীতপ্রেমীরা সারা বছর অপেক্ষা করতেন ‘পুজোর গান’ এর জন্য। অমিতকুমারের ‘সাগরিকা’ নামে একটা অ্যালবাম দারুন জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়া নব্বইয়ের দশকের বিভিন্ন হিন্দি ছবির গানও পুজো প্যান্ডেলে বাজত- রাজা, বাজ়িগর, সাজন্, আশিকী, রাজা হিন্দুস্তানী আরও কত সব সিনেমার গান। লাউড স্পিকারের ব্যবহার কম ছিল। চোঙ্গা মাইক ই বাজত বেশী। এখন সে রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। পাইরেসি, MP3 আর ডাউনলোডের ত্র্যয়োস্পর্শে ক্যাসেট আজ অতীত। ক্যাসেটের দোকান গুলিও একটা একটা করে বন্ধ হয়ে গেল। এখন মেমোরী চিপে হয়তো হাজার হাজার গান জমিয়ে রাখা যায়, কিন্তু তাতে সময়ের গন্ধ বা স্মৃতিমেদুরতা একেবারেই নেই। ক্যাসেটের যুগে একটা গান থেকে আর একটা গানে স্কিপ করতে সময় লাগত। এখন মোবাইলের যুগ। স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়ালেই গান পাল্টে যায়, ফলে পুরো গানটা শোনার মত ধৈর্য এখন আমাদের নেই। ভালো না লাগলে, বাড়ি, গাড়ী বান্ধবীর মত গানও ঝট্ করে পাল্টে নেওয়া যাচ্ছে।

          পুজোর ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী খুব আনন্দে কাটলেও , নবমীর রাত থেকেই একটা দুরু দুরু ভাব বুকের মধ্যে টের পেতাম। কালই যে দশমী, মায়ের কৈলাসে ফিরে যাওয়ার দিন। মন বলত ‘যেওনা নবমী নিশি’। বিশ্বাসই হতো না যে আজ রাতটা কেটে গেলেই এত আলো, লোকজন, হাসি, শব্দ, গন্ধ মেশা পুজোটা শেষ! তাই নবমীর রাতটাতে যতক্ষণ বেশী বাইরে থাকতে পারি, যত বেশী করে উৎসবের রূপ, রং, রোশনাইতে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিতে পারি, তারই চেষ্টা করতাম।

         দশমীর দিন সকালে একটা অদ্ভুত কষ্ট আর কাউকে বোঝাতে না পারা একটা মনখারাপ নিয়ে ঘুম ভাঙত। একটু বেলা হলে পাড়ার কাকীমা দের সাথে আমার মা মণ্ডপে যাবেন সিঁদুর খেলতে। লালপাড় সাদা শাড়ীতে দারুন পবিত্র আর ব্যাক্তিত্বময়ী দেখায় মাকে। দশমীর দিন একটা বড় মেলা বসত ফুটবল মাঠের চণ্ডীমণ্ডপের সামনে। মেলাটা এখনও বসে। মোটামুটি একই রকম আছে ঐ জায়গাটা।কোনও কোনও বার মা আমাকে দশমীর মেলায় নিয়ে যেতেন।

          ভাসান হতো দশমীর পরদিন। সমস্ত পুজো কমিটি, তাদের প্রতিমা গুলিকে নিয়ে ট্রাকে, লরিতে, ম্যাটাডোরে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ত শহরের রাস্তায়। সঙ্গে থাকত অনেক ঢাকি। তাদের ঢাক একই ছন্দে একই তালে বাজিয়ে দারুন শোভাযাত্রা করে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেত সবাই। কিছু কিছু দলের একদম সামনের সারিতে থাকতেন মহিলারা।অনেকেরই পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ী। তাদের হাতে শঙ্খ। সেগুলিও বেজে উঠত মাঝে মাঝে। দৃশ্যটার মধ্যে যে মাধুর্য, আভিজাত্য আর সৌন্দর্য্য ছিল, তার কনামাত্রও নেই এখনকার বুক কাঁপানো সাব-উফার, লাউডস্পীকার, ডি. জে. আর ডিজিটাল স্ট্রোব লাইটের কৃত্তিম আলোর ঝলকানিতে মাতাল হয়ে নাচতে থাকা উন্মত্ত নবীন তরুনদের মধ্যে।মাঝে মাঝে মনে হয়, যেন আদর্শহীনতা ও উগ্রতার মধ্যেই একটা তরল আনন্দ তারা খুঁজে পাচ্ছে। কিছু কিছু গানের কথা যেমন নোংরা তেমনি কুৎসিত তাদের  অঙ্গভঙ্গী, আর কারণবারি সহকারে নাচ। আর এই উগ্রতা, অসভ্যতা আর দম্ভ মেশা অপসংস্কৃতি যেন উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।কিন্তু তার জন্য নবীন দের কোনও ভাবেই দোষী করা যায় না।গোটা সমাজ টাই যে আজ পচে গেছে।ঘুন ধরে গেছে আমাদের মূল্যবোধেও। ন্যায় অন্যায় ভুলে, যে ভাবেই হোক টাকা কামাবার জন্য আমারা সবাই যে পাগল হয়ে গেছি। সুমন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেলেন ‘আসছে শতাব্দীতে, আসব ফিরে তোমার খবর নিতে।’ মানুষ সব সময়ই ভবিষ্যতের কাছে আশাবাদী।কিন্তু মাঝে মাঝে বড় ভয় আর আশঙ্কা হয়,এ কোন ভোগবাদী, লোভ সর্বস্ব, ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা? কিন্তু ভবিষ্যতের কাছে, পরম করুনাময় ঈশ্বরের কাছে, ‘ভালো দিন’ এর আশা করা ছাড়া, আমাদের যে আজ আর কোনও উপায় নেই। তাইতো উপনিষদেও আমরা খুঁজে পাই সেই চিরকালীন প্রার্থনা ......


“অসতো মা সদগময়

তমসো মা জ্যেতির্গময়

মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়”

                  উপরের কথা গুলো বোধহয় ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ হয়ে গেল।কিন্তু ইংরিজিতে একটা কথা আছে ‘down memory lane’, আমার এই লেখার উদ্দেশ্যও তাই- সদ্য বিগত অতীতের, আমার শৈশবের পুজোর দিন গুলোর কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতিকে একসাথে জুড়ে, হারিয়ে যাওয়া একটা সময়কে ফুটিয়ে তোলার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। তাই একটা তুলনামুলক আলোচনা প্রসঙ্গক্রমে চলে এসেছে।এই গুলো নিতান্তই আমার ব্যাক্তিগত মত।সবাই একমত নাও হতে পারেন, কিন্তু আমার যা মনে হয়েছে আমি সেটাই অকপটে তুলে ধরেছি এখানে।

                 সময়কে ধরে রাখা যায়না, নদীর স্রোতের মতই তা সব সময় বয়ে চলেছে,কিন্তু তবুও মনের মণিকোঠায় রয়ে যায় কিছু স্মৃতি, তাইতো কষ্ট হলেও মা কে বিদায় দিতেই হয়। মা দুর্গারও নিশ্চয়ই আমাদের ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়। ভাসানের সময় মৃন্ময়ী মূর্তি যখন জলে ফেলা হয় তখন মায়ের চোখের কোনাটাও কি একটু চিকচিক করে ওঠে না?যে নদীতে মহালয়ার ভোরে পিতৃপুরুষকে তর্পণের মধ্যে দিয়ে সূচনা হয়েছিল উৎসবের, সেই একই নদীতে বিসর্জনের মাধ্যমেই সমাপ্তি হয় তার। ভাসানের সময় কপালে হাত ছুঁইয়ে বড়োরা বলতেন – ‘আবার এসো মা’, ভাসান দিচ্ছেন যে কাকুরা, দাদারা তারা বলত- ‘দুগ্গা মাই কি, জয়’ কিংবা ‘আবার কবে, বছর পরে’।

                   ভাসানের পর বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বন্ধুদের মধ্যে হিসেব করা শুরু হয়ে যেত ‘সামনের বছর পুজো কবে পড়েছে রে ?’ মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এইতো মাত্র একটা বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। অবশ্য বাড়িতে ঢুকেই চিনি-গুড় জ্বাল দেওয়ার ম ম গন্ধে মন খারাপ টা কেটে যেত। মা আর মায়ের পিসি, যাকে আমি পিসি দিদা বলে ডাকি। দুজনে মিলে নারকোল নাড়ু, তক্তি, কুচি নিমকী, মুড়ির মোয়া, খৈয়ের মুড়কী বানাতেন।কারন একটু পরেই পাড়া প্রতিবেশীরা বিজয়ার শুভেচ্ছে আর প্রনাম জানাতে এসে পড়বেন।তাঁদের তো আর খালিমুখে ফেরানো যায় না, তাই মিষ্টিমুখের আয়োজন। এখনকার মত দোকান থেকে কিছু একটা কিনে এনে নয়, অতিথি সৎকার করা হত ঘরে তৈরি খাবার দিয়েই। আর তাতেই আন্তরিকতা খুঁজে পেতেন সবাই। বৈভব নয়, আপ্যায়নের মাপকাঠি ছিল আন্তরিকতাই। বিজয়ার শুভেচ্ছা আর প্রনাম জানানো চলত চিঠি আর ফোনের মাধ্যমেও, যেটা এখন ফেসবুক আর হোয়াটস্অ্যাপে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।

                   আমার ছোটবেলার, বিশ্বকর্মা পুজো থেকে বিজয়া পর্যন্ত কিছু ছবি, শারদীয়া গন্ধ মাখা কিছু স্মৃতি তুলে ধরলাম পাঠকের কাছে। জানি দিনগুলি আর হয়তো ফিরে আসবে না, তবুও কবিগুরুর ভাষায় বলি –


“ভরা থাক্‌ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।

মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিয়ো আনি ॥”

Comments

  1. খুউব সুন্দর লেখা।পূজোর স্মৃতি এভাবেই জড়িয়ে রাখে আমাদের

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ। আপনার মত একজন মননশীল ও গুণী মানুষের যে আমার লেখা ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম।

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

সবুজ ডুয়ার্স, নীল পাহাড় আর এক টুকরো ইতিহাস - অর্ণব রায়

প্রাচীন বাংলার দুর্গাপূজার পটভূমিকায় জলপাইগুড়ি : অর্ণব রায়