প্রাচীন বাংলার দুর্গাপূজার পটভূমিকায় জলপাইগুড়ি : অর্ণব রায়

  


         আজ শরৎকালীন যে  দুর্গোৎসব বাংলার অন্যতম প্রধান উৎসব তার শুরু ১৭৫৭ সালেসেবছরই জুন মাসে পলাশির যুদ্ধে বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ইংরেজদের জয়কে সেলিব্রেট করার উদ্দেশ্যে এবং  বাংলার কিছু ধনী ব্যক্তি, রাজা ও জমিদার শ্রেনীর উদ্যোগে এবং  মূলত ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভের উৎসাহেই সূচনা হয় হয় এই উৎসবের তাঁরা চাইছিলেন এমন একটি উৎসবে পালন করতে যা হিন্দু প্রজাদের মনেও প্রভাব বিস্তার করবে আবার পলাশীর যুদ্ধের স্মারক হিসেবেও থেকে যাবে।বসল আলোচনা সভা, খোঁজ শুরু হল উৎসবের। তত্ত্ব তালাশ করে দ্যাখা গেল, কোলকাতা  সন্নিহিত অঞ্চলে ১৬১০ সাল থেকে  বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরি পরিবারে দুর্গাপুজোর প্রচলন থাকলেও, ১৫৮২ সালে বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ন যে উৎসব শুরু করেন তার জৌলুস ছিল দেখবার মত। এযুগের হিসেবে প্রায় এক কোটি টাকা খরচ হত সেই উৎসবে। সেই ইতিহাসের খবর দেশীয় রাজাদের মারফৎ পৌঁছায় ক্লাইভের কানেও, সেই ধাঁচেই পরিকল্পনা করা হয় উৎসবের। সেই মোতাবেক নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে শুরু হয় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে উৎসবএছাড়াও বাংলার নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন পুজোর নিদর্শন

     গল্পটা এই অবধি মোটামুটি আমরা অনেকেই হয়তো জানি। কিন্তু আজ আমি আপনাদের কিছু নতুন কথা বলব। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে, হিমালয়ের পাদদেশে থাকা জলপাইগুড়ি জেলার সাথে এই বাঙালির দুর্গাপুজোর সূচনালগ্নের ইতিহাসের সম্পর্ক নিয়ে। এক্ষেত্রে দুটো পুজো নিয়ে আমরা কথা বলবযার একটির সম্পর্কে (রাজশাহীর রাজা কংসনারায়নের দুর্গা পুজো)  ইতিমধ্যেই আমরা কিছুটা আলোচনা করেছি। আর অন্য পুজোটি হল জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ীর দুর্গাপুজো।এই পুজো উপলক্ষ্যে সমগ্র জলপাইগুড়ি শহর তথা জেলা থেকে জনসমাগম হয়। এই পুজো হয় কালীকা পুরাণ মতে।

     ১৫০৯ সালে শুরু হওয়া এই পুজোটিই সম্ভবত এখনও পর্যন্ত বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপুজো। এবছর পুজোটি পড়ছে পাঁচশো এগারোতম বছরেঅরণ্যে ঘেরা বৈকুণ্ঠপুর এস্টেট ছিল একটি দেশীয় রাজ্য, ইংরেজরা যাকে বলতেন নেটিভ স্টেট’। রাজ্যটি আজ না থাকলেও সেই নামেই আজও রয়েছে শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে অবস্থিত বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা, শিষ্য সিংহ (ইনি ছিলেন পার্শ্ববর্তী রাজ্য কোচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহের ভাই)  শুরু করেন এই দুর্গাপুজো। এই বংশের  শেষ রাজা ছিলেন প্রসন্ন দেব রায়কত। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল রানী অশ্রুমতী দেবী। তাঁদের একমাত্র কন্যা ছিলেন রাজকুমারী প্রতিভা দেবী। 

*

       রাজপরিবারের বর্তমান সদস্য, তথা রাজকুমারী প্রতিভা দেবীর পুত্র প্রণতকুমার বসুর তত্ত্বাবধানে বর্তমান পুজোটি অনুষ্ঠিত হয় ( প্রখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব গুহ তাঁর একাধিক উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসুর সাথে এই পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। উনি ছিলেন রাজকুমারী প্রতিভা দেবীর স্বামী ড. কিরন বসুর আপন ভাই।) 

জন্মাষ্টমীর পরের দিন হয় নন্দোৎসব দুর্গা দালানের পার্শ্ববর্তী পুকুরের কাদামাটির সঙ্গে দই মিশিয়ে দেন পুরোহিত এরপর কিশোর ও তরুনেরা  শুরু করে সেই কাদা দিয়ে দোল খেলা, যা এখানে দধি কাদো খেলা নামে পরিচিত তবে এ বছর মাত্র দুজন এই কাদা খেলায় অংশ নেয় এই দধি কাদো খেলার মাটি, প্রতিমা তৈরির বিশেষ এঁটেল মাটিতে মিশিয়েই দুর্গাপ্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয় বৈকন্ঠপুর রাজবাড়িতেপ্রাচীন নিয়ম অনুযায়ী সেদিন দুপুরে কাঁসর, ঘণ্টা ও ঢাকের বাদ্য সহকারে অন্নভোগ সাজিয়ে দেওয়া হয় দুর্গা দালানে রাখা কাঠামোর সন্মুখেএভাবেই নিষ্ঠা সহকারে সম্পন্ন করা হয় কাঠামো পূজা

দেবীর কাঠামো নির্মাণ করার জন্য ময়না গাছের কাঠ ব্যবহার করা হয় পুজোর আয়-ব্যয়ের হিসেবের খাতায় সবার প্রথমেই উল্লেখ করা থাকে এই ময়না কাঠের প্রাচীন তথ্যাদি অনুযায়ী দেবীর গায়ের রং তপ্তকাঞ্চন বর্ণা তবে ১৯৪৬ সালে রাজা প্রসন্নদেব রায়েকতের মৃত্যুর পর থেকে বেশ কিছু বছর এই মূর্তিটিতে লাল রং ব্যবহার করা হয়েছিল কারণ তপ্তকাঞ্চন বর্ণ রংটি ঠিক কেমন সেই সম্পর্কে মূর্তিকারদের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালে প্রাচীন তথ্যাদি আবিষ্কারের পর, জলপাইগুড়ি শহরের টেম্পল স্ট্রিটের স্বর্ণকার লক্ষন কর্মকার হাতে কলমে সোনা গলিয়ে দেখান তপ্তকাঞ্চন বর্ণের সঠিক রূপ ফটোগ্রাফার বাচ্চু দাস সেই সোনা গলানোর মুহূর্তটিকে তাঁর ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করেন সেই ছবি তিনি প্রণত কুমার বসু ও জলপাইগুড়ির প্রখ্যাত গবেষক উমেশ শর্মা কে দেখান তারপর থেকে অর্থাৎ ২০০২ সাল থেকে দেবী প্রতিমা স্থায়ীভাবে তপ্তকাঞ্চন বর্ণা

          এখানকার দেবীপ্রতিমা একচালা এই একচালার মধ্যেই দেবীদুর্গা ও তাঁর চার সন্তান রয়েছেন দেবীর ডানদিকে রয়েছেন লক্ষ্মী ও গনেশ আর বাঁদিকে সরস্বতী ও কার্তিকদেবীর দুই সখী জয়া এবং বিজয়া দাঁড়িয়ে আছেন একচালার বাইরে অন্যান্য পুজো থেকে এই পুজোর আরও একটা বড় তফাৎ হল এই যে,   এখানে দুর্গার স্বামী মহাদেবকে মূর্ত রূপে দেবীর সাথেই পুজো করা হয় সঙ্গে ভগবান ব্রহ্মা এবং একটি ছোট সিংহাসনে ঘটের সামনে বৈকুন্ঠপুর এর অধিদেবতা বৈকুণ্ঠনাথ তথা বিষ্ণু বিরাজ করছেনআর থাকেন কলাবৌ এছাড়াও থাকেন জেলার লৌকিক দেবী মেছেনি তাঁর মূর্তিকে দেখা যায় বঁটি দিয়ে মাছ কাটতে


পুজোর চারদিনই মা কে ভোগ দেওয়া হয়।আমিষ ভোগ এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত ভোগে থাকে কাতলা মাছ, ইলিশ মাছ, পাবদা মাছ ও পাঁঠার মাংস। একটা সময় দূর দুরান্ত থেকে মানুষ আসতেন এই পুজোর উৎসবে অংশগ্রহণ করতে, প্রজাদের জন্য প্রত্যেকদিন খাবারের ব্যবস্থা থাকত।এছাড়াও রাজবাড়ির মাঠে দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে বিরাট মেলা বসত।

অষ্টমীতে এই পুজায় পাঁঠা,পায়রা,হাঁস, চালকুমড়া, আখ ইত্যাদি বলি হয়প্রাচীন কালে মোষ বলি হতো। তবে এবছর করোনা অতিমারীর প্রাদুর্ভাবের ফলে দুর্গাপূজায় বলি স্থগিত রাখা হচ্ছে বলে রাজপরিবারের তরফে জানানো হয়েছে

*

চার চাকা যুক্ত একটি রথ আকৃতির পাটাতনে দেবী দুর্গার এই একচালা মূর্তিটি গড়ে ওঠে এই একই পাটাতনে প্রতিবছর দেবী দুর্গার পুজা করা হয় কারণ প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী এখানে দেবীর বিসর্জন হয় না শুধুমাত্র নিরঞ্জন হয় অর্থাৎ বিজয়া দশমীর দিন মিষ্টিমুখ ও সিঁদুরখেলার পর, দেবী প্রতিমাকে রাজবাড়ীর নিজস্ব পুকুরের জলে ফেলার পর, কাঠের পাটাতনটিকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় মণ্ডপে প্রয়োজনে নতুন কাঠ সংযোজন করে সেই একই পাটাতন ব্যবহৃত হয় প্রতিবছর এই প্রথাই বিগত পাঁচশো বছর ধরে চলে আসছে

এক সময় এই পুজো উপলক্ষ্যে রাজার হাতি শালার হাতিগুলিকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে পুজো দেওয়া হতো বরণডালা, ধুপ-ধুনো, প্রদীপ, নৈবেদ্য সহযোগে এই প্রথাটিকে বলা হত 'হাতি চুমানি' দশমীর পরের দিন রাজা হাতিশালার সবচেয়ে সেরা হাতিটির উপর বসে শিকারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন এই প্রথাটিও ছিল উৎসবেরই একটি অঙ্গআর এর মধ্যে দিয়েই উৎসবের সমাপ্তি ঘটত।

এবারে ফিরে আসি , এই লেখার সূচনাতে যে জাঁক জমক পূর্ণ উৎসবের প্রসঙ্গ এসেছিল, সেই রাজশাহীর কংসনারায়নের পুজোর প্রসঙ্গে। সচেতন পাঠক ভাবতে পারেন সেই পূজার সাথে জলপাইগুড়ির সম্পর্ক কি?

সম্পর্ক হল এটাই যে, সেই বিখ্যাত পূজার আয়োজক রাজা কংসনারায়নের বর্তমান বংশধরেরা বাস করেন জলপাইগুড়ি শহরেই। দেশভাগের পর দেবীমূর্তি সহ তাঁরা ভারতে চলে আসেন। এখানকার পাণ্ডা পাড়া এলাকার চক্রবর্তী পরিবারে আজও পূজা পেয়ে চলেছেন সেই অষ্টধাতুর দুর্গা মূর্তি। সঙ্গে রয়েছেন কার্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীও। সেই বিরাট উৎসবের জৌলুস না থাকলেও, নিষ্ঠা সহকারে বাড়ির অন্দরমহলেই পূজাটি অনুষ্ঠিত হয়।


অবিভিক্ত বাংলার রাজশাহীর তাহেরপুরের সামন্তরাজা ছিলেন কংস নারায়ণ।পাঠান আমলে ফৌজদার হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন বেশ কিছুদিন। চট্টগ্রাম এলাকায় মগ জলদস্যুদের দমনে ইনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুঘল আমলে তাঁকে বাংলা বিহারের অস্থায়ী দেওয়ান পদের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সম্রাট আকবর তাঁকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। ওনাকে স্থায়ী দেওয়ান পদ দেওয়া হলেও তিনি তা নিতে চাননি, তিনি তাঁর নিজের রাজত্বেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রজা হিতৈষী রাজা। শেষ জীবনে তিনি তাহিরপুরে ফিরে এসে নানান প্রজাকল্যাণমূলক ও ধর্মীয় কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময়ে তাঁর রাজা উপাধি প্রাপ্তি উপলক্ষে  তিনি যে বিরাট দুর্গোৎসবের সূচনা করেন তা আজও ইতিহাসের পাতায় চিরভাস্বর হয়ে আছে। 


 (প্রবন্ধটি 'বাংলা আমার প্রাণ' পত্রিকার ২০২০ উৎসব সংখ্যা 'মৃন্ময়ী'তে প্রকাশিত হয়েছে।) 

 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার-

অধ্যাপক শ্রী স্বপন ভৌমিক ও অধ্যাপক শ্রী দেবকুমার সেনগুপ্ত,    

মালবাজার পরিমল মিত্র স্মৃতি মহা-বিদ্যালয়,জলপাইগুড়ি

আবীর ঘোষ, কোচবিহার

নিলাদ্রী পাল, ময়নাগুড়ি

জলপাইগুড়ি শহরের একশো বছর- ডঃ চারুচন্দ্র সাণ্যাল

শারদীয়া শুকতারা পত্রিকা

'শারদীয়া আজকাল' পত্রিকা

দ্যা ওয়াল পত্রিকা

বঙ্গ-দর্শন পত্রিকা

The Statesman পত্রিকা

* ছবির জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই জলপাইগুড়ির শ্রী রাহুল বণিক কে। 


 

 

    


Comments

Popular posts from this blog

সবুজ ডুয়ার্স, নীল পাহাড় আর এক টুকরো ইতিহাস - অর্ণব রায়

ফিরে দেখা: আমার ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি- অর্ণব রায়